গল্প,পর্ব:২বাসায় যেতে যেতে যেতে ভাবলাম কালো টিপ নীল চুড়ি সাথে খোঁপাতে কথাকে আজ অষ্টাদশী তরুণী লাগবে। ভাবতে ভাবতে একদম বাসার সামনে এসে পড়ি। তারপর বাসায় এসে দরজা ধাক্কা দিতেই আমার হাতের ফুলগুলো পড়ে যায়।



কারন দরজা খুলেই দেখলাম রাফি আর কথা পাশাপাশি বসে রোমান্টিক ছবি দেখছে। রাফি কথার হাতটা ধরে আছে। আর কথা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর কথা আমাকে দেখে রাফির হাতটা ছেড়ে দিলো। তখন আমি কিছু বলে ওঠার আগেই রাফি সাহেব বললো।



রাজ ভাই কেমন আছেন?সামনে সপ্তাহে আমাদের রাকিবের বার্থডে। আপনি আর ভাবী যাবেন অবশ্যই। আর হ্যাঁ ভাবীকে অবশ্যই নিয়ে যাবেন। এ মুহুর্তে আমি কি বলবো ঠিক ভেবে পাচ্ছি না। রাগে শরীর কাঁপছে। আমার বউয়ের সাথে লুতুপুতু।



এদিকে কথা নিচে পড়ে থাকা ফুলগুলো তুলে চুমু খেয়ে খোঁপায় জড়িয়ে নিল। তারপর রাফি সাহেব বের হতেই। আমার বুকটা কেমন করে ওঠলো। কথাকে কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না। আমি কথাকে ভালোবাসি এক কথায় নিজের থেকেও বেশি। আর রাইসা কথাকে ছাড়া কিছুই বুঝে না। কথাকে ছাড়া আমার কোন বিকল্পও নেই।



রাতে শুয়ে শুয়ে কথার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো মনে করছি। মানুষ কিভাবে এতোটা পাল্টে যায়? সত্যিই পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হচ্ছে প্রিয় মানুষের অন্য রুপ দেখা। তখন হঠাৎ ফোনটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে ওঠলো। ফোনের দিকে তাকাতেই দেখি সুমাইয়া ফোন। ফোনটা তুলতেই সুমাইয়া বললো।



—হ্যালো জান কেমন আছো?
–হ্যাঁ ভালো তুমি?



—তোমাকে ছাড়া কিভাবে ভালো থাকি বলো? জানো খুব মিস করছি তোমায়। তোমার প্রতিটা স্পর্শ আমি সবসময় ফিল করি। আর রাফি গাদাটা কিছুই করতে পারে না। জানো আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি। আর হ্যাঁ কাল দুপুরে বাসায় এসো। রাফি শহরে যাবে। রাকিবের বার্থডে গিফট কিনতে।



–আচ্ছা।
—এই শোন না একটা কিস করো?
–উম্মাহ্! কাল মন ভরে আদর করবো।



ফোনটা কেটেই পিছনে তাকিয়ে দেখি কথা দাঁড়িয়ে আছে। কথার চোখের কার্ণিশ বেয়ে জল পড়বে পড়বে ভাব। তখন নিরবতা ভেঙে আমিই বললাম।



–কিছু বলবে?
—তুমি তো ডিনার করোনি। অফিস থেকে আসার পর থেকেই দেখি যে তোমার মন খারাপ। খাবে না?
–রাইসা খেয়েছে?



—হুম ওকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি।
–আচ্ছা তুমি শুয়ে পড়। আমি খেয়ে নিচ্ছি।



তারপর কথা কিছু না বলে শুয়ে পড়ল। টেবিলে গিয়ে বসতেই দেখি, দু’প্লেটে খাবার দেওয়া। বুঝতে আর বাকি রইল না কথা খায়নি। আমি খাবার শেষ করে বিছানায় যেয়ে গা টা এলিয়ে দিলাম। বিছানায় শুওয়ার কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম কথা চাঁপা কান্না করছে। মন চাচ্ছে কথার চোখের জলটা মুছে দিয়ে বুকে টেনে নেয়। কিন্তু রাফি সাহেবের কথা মনে পড়তেই বুকটা ধুমগে মুচড়ে গেল।



সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই দেখি কথা আমার বুকে। একদম মাসুম বাচ্চার মতো লাগছে। মন চাচ্ছে ভাজহীন কপালটাতে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দেয়। কিন্তু না পারলাম না। রাইসার কথাগুলো মনে হতেই কেমন যেন ঘৃণা এসে গেল। কথাকে বুক থেকে সরিয়ে ফ্রেশ হয়ে অফিস চলে গেলাম।



দুপুর বেলা আবারো সুমাইয়ার ফোন। সুমাইয়ার ফোন পেয়ে তাড়াহুড়া করে তার বাসায় চলে যায়। বাসায় গিয়ে দেখি সুমাইয়া রাকিবকে কুলে নিয়ে টিভি দেখছে। আমাকে দেখেই সুমাইয়া রাকিবকে টিভি দেখতে বলে ওঠে পড়লো।



—মম তুমি কোথায় যাচ্ছো? চলো না আমরা একসাথে টম এন্ড জেরী দেখি। (রাকিব)
—আচ্ছা বাবা তুমি দেখো আমি অন্যদিন দেখবো।(সুমাইয়া)



তারপর আমরা সুমাইয়ার রুমে গিয়ে বসতেই সুমাইয়া দরজাটা লাগিয়ে দিতে চাইলেও আমি না করলাম। কারণ আজ তো রাফি আসার ভয় নেই। সুমাইয়া তখন মৃদু হাসল। নীল রঙের শাড়িতে সুমাইয়াকে আজ অপূর্ব লাগছে। মন চাচ্ছে সুমাইয়ার ওষ্ঠ ধরে ভালোবাসার স্পর্শ এঁকে দেয়। তারপর সুমাইয়া আমার কাছে এসে বসলো। ঠিক যতটা কাছে আসলে নিঃশ্বাসের শব্দটাও শোনা যায়।



তার পর সুমাইয়াকে জড়িয়ে ধরে হারিয়ে গেলাম অন্য জগতে। এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর নিস্তেজ দেহটা নিয়ে সুমাইয়ার উপর শুয়ে পড়লাম। তখন হঠাৎ বিছানায় থাকা মোবাইলটা ক্রিং ক্রিং করে বাজতে লাগলো। মোবাইল ধরতেই ওপাশ থেকে কেউ একজন মায়াভরা কন্ঠে বললো।



—খেয়েছো তুমি?
–হুম খেয়েছি তুমি খেয়ে নিয়ো।



বলেই আমি সুমাইয়ার উপর থেকে উঠে রেডি হচ্ছি। সুমাইয়াও কাপড় পড়ছে এমন সময় রাকিব মা মা করে দৌড়ে এসে দরজা খুলে ফেলে। এদিকে সুমাইয়া আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে। সুমাইয়া রাকিব এভাবে ঢুকতে দেখে সাথে সাথেই রাকিবের গালে একটা চড় বসিয়ে দেয়।



—তোমাকে না বলছি, টিভি দেখতে? এখানে আসছো কেন?
ছোট্ট রাকিব কান্নামাখা ভয়াত দৃষ্টিতে বললো।
—মম তুমি তো দুপুরে খাওনি? আসো তোমাকে খাইয়ে দেয়। (রাকিব)



আমি ছোট্ট ছেলেটার কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। তখন আমার রাইসার কথা বারবার মনে পড়ছে।
ঠিক এমনটাই হয়তো রাইসার সাথেও হয়েছিলো। সত্যিই প্রকৃতির বিচার বরং নিষ্ঠুর। তখন আমি সুমাইয়াকে কিছু না বলে, রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। বাসায় এসে দেখি কথা কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। আমি কথার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দাঁড়িয়ে শুনলাম,



—জানো রাফি তোমাকে অনেক মিস করছি। আমার স্বামীটা আমার দিকে একবার ভালো করে তাকায় না পর্যন্ত। বলো এ চেহারা দিয়ে কি করবো? তুমি আমাকে সুখী করেছে। আচ্ছা আবার কবে দেখা হবে?(কথা)



আমি কথার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে আচাড় মারলাম। হঠাৎ কথা জড়োসরে হয়ে গেল আমার ব্যাবহারে।
কিন্তু কিছু বললো না। ভাবছিলাম কথাকে একটা থাপ্পর দেয়। কিন্তু না ওকে থাপ্পর দিলে যে আমারি কষ্ট হবে। সবকিছুর বড় সমাধান হবে, কথাকে নিয়ে এ শহর ছেড়ে চলে যাওয়া। যেখানে থাকবে না রাফি নামে কেউ।



পরের দিন সকালেই কথাকে বললাম আমরা এখান থেকে চলে যাবো। ব্যাগপত্র গুছিয়ে নাও। কথা মনে হয় আগে থেকেই যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলো। ঢাকা ছেড়ে আসার সময় সুমাইয়াকে একটা ম্যাসেজ দিলাম।



“প্রিয় সুমাইয়া পৃথিবীতে কোন স্বামী যেমন তার স্ত্রীর ভাগ কাউকে দিতে চায় না। তেমনি কোন স্ত্রী ও চায় না। আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আমাদের এ দৈহিক আনন্দ ভবিষ্যৎ এ আমাদের বাচ্চাদের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। আর আমি তোমার জীবনে কে ছিলাম এটা ভুলে গিয়ে তোমার স্বামী সন্তানকে নিয়ে ভালো থেকো। আর হ্যাঁ, তোমার সন্তানটা সত্যিই ঝিনুকে থাকা মুক্তোর মতো। তাকে খারাপ বানিয়ো না প্লিজ।



ম্যাসেজটা পাঠিয়ে সিমটা ফেলে দিলাম।
আমরা শহর ছেড়ে এসেছি অনেকদিন হলো। কথাও সেই আগের মতোই হয়ে গেছে আমিই যেন তার পৃথিবী। পাঁচ ওয়াক্ত নামায আর পর্দাতে থাকে। সাথে আমিও নিজের কর্মের জন্য প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। সত্যিই শহর ছেড়ে আমি আমার ভালোবাসাকে খুঁজে পেয়েছি। কথার প্রতিটা নিঃশ্বাসে আমি আমাকে খুঁজে পায়। তো হঠাৎ একদিন কথা মাথা ঘুরে পড়ে যায়। হসপিটালে নিয়ে গেলে ডাক্তার কয়েকটা টেস্ট দেয় করাতে। টেস্টগুলো করানোর পর শুনি কথার ব্রেন টিউমার পৃথিবীতে মাত্র কয়েকদিনের অতিথি।
আমি কথাটা শুনে কি করবো ভেবে পাচ্ছি না। অফিস থেকে একমাসের ছুটি নিয়ে নিলাম।



এখন কথার সাথেই সবসময় থাকি। তারপর একদিন কথা হঠাৎ অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ল। আমাকে তার কাছে নিয়ে বসালো। আর বললো।
—রাজ তোমার সাথে আমি থাকতে পারলাম না। আর রাইসা মা আমার আলমারিতে রাখা নীল ডাইরিটা নিয়ে আন তো মা।
রাইসা আলমারি থেকে একটা ডাইরি নিয়ে এসে কথার হাতে দিলো।



—রাজ ডাইরিটা আমি চলে যাওয়ার পর খুলবে। অনেক অজানা কথা হয়তো জানতে পারবে। রাজ আমাকে একটু বুকে নিবে? জানো আজ আমি খুব সুখী হয়তো তোমার বুকে আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারবো। নাও না একটু বুকে?



তারপর কথাকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। কথার চোখের পানিতে শার্ট ভেজে যাচ্ছে। কথা তোতা পাখির মতো বলছে।
—জানো রাজ আজ, আমি সত্যি অনেক ভাগ্যবতী। আমি হয়তো তোমার বুকে মাথা রেখে মরতে পারবো?এই তুমি কাঁদছো কেন? এমন ভাগ্য কয়জনার হয়?রাজ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরো আমার খুব কষ্ট হচ্ছে খুব। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।



–তোমার কিছুই হবে না। কোথাও যাবে না তুমি।
কি হলো কথা বলো? কথা বলছো না কেন? এই চুপ করে থাকবে? কি হলো কথা বলো।
এমন সময় ডাক্তার এসে কথার পালর্স চেক করে বলল’
—স্যরি সে আর ফিরবে না।



ডাক্তারের কথাটা যেন কলিজাতে এসে বিঁধল। রাইসা বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে লাগলো।
তারপর কথাকে দাফন করার কিছুদিন পর, কথার দেওয়া নীল ডাইরিটা বের করে পড়তে লাগলাম।
ডাইরির প্রথম পাতায় সুন্দর করে লেখা’
“কোন এক নিশীতে আমি চায় না যে তোমায়! আমি তোমাকে চায় প্রতিটা নিঃশ্বাসে।



ডাইরির পরের পাতা উল্টাতেই দেখলাম নীল কালিতে লেখা’
“আচ্ছা আমি কি দেখতে খারাপ হয়ে যাচ্ছি? রাজ ঠিকমতো আমায় ভালোবাসে না। আগের মত পাগলামী করে না। খুব কষ্ট হয় আমার।
পরের পাতা উল্টাতেই দেখলাম।



আজ রাফি ভাইয়া এসেছিল। পু'রুষ মানুষ কাঁদতে পারে তা আমার জানা ছিলো না। রাফি ভাইয়ার একটা ছেলেও আছে নাকি শুনলাম। তখন রাফি ভাইয়া আমার হাত দুটি ধরে বললো’ “আমার কোন বোন নেই। আজ থেকে তুমি আমার বোন। তুমিই পারো দু’টি সংসার ভাঙা থেকে রক্ষা করতে!



জানো রাজ ভাইয়ার সাথে আমার স্ত্রী সুমাইয়ার অবৈধ সম্পর্ক চলছে। আমি একদিন দেখেও ফেলেছি। কিন্তু রাজ ভাইয়া এবং সুমাইয়া কাউকে কিছু বলতে পারিনি। সুমাইয়াকে তালাক দিলেও আমার ছেলেটার কি হবে? কারণ আমারো মা পাঁচ বছরের সময় আরেক লোকের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল। সমাজে সবার লাথিগোড়া খেয়ে আজ এখানে। আমি চাই না আমার ছেলেটার অবস্থাও আমার মতো হোক। বোন তুমিই পারো তোমার স্বামীকে সঠিক পথে আনতে।



—কি করতে হবে?
রাফি সাহেব তখন অবৈধ সম্পর্কের অভিনয় করতে বলে আমাকে। আর রাইসা ছোট্ট হলেও এ অভিনয়ে তার দায়িত্বটা নিপুনভাবে পালন করে আমাদের ছোট্ট মেয়েটা। সত্যি বলতে আমার জীবনে কেউ ছিলো না রাজ। আমি জানি তুমি আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসো। কিন্তু তুমি অন্য নারীর মোহে পড়ে গিয়েছিলে।



তাই মিথ্যার অভিনয় করে তোমাকে নিয়ে শহর ছেড়ে আসার প্ল্যান করেছিলাম। আর জানো প্রতি ওয়াক্ত নামায পড়ে তোমার হেদায়েত চাইতাম। আল্লাহ যেন আমার কলিজাকে আমার করে দেয়। জান্নাতে যেন আমরা একসাথে থাকতে পারি। জানো কখনো কখনো মাঝরাতেও নামাযে দাঁড়িয়ে যেতাম। আল্লাহকে খুশি করার জন্য,। আল্লাহ আমার ডাক শুনেছে।



রাফি সাহেব পেয়েছে তার স্ত্রী সন্তানকে আমি পেয়েছি আমার অলংকারকে। বড্ড ভালোবাসি তোমায়। তোমার কথা ফুলের মতো নিঃষ্পাপ আছে। তোমার কথা যে তোমাকে নিয়ে জান্নাতে থাকতে চাই। ক্ষমা করে দিয়ো। সত্যটা গোপন করার জন্য।



ইতি,
তোমার কলিজার টুকরা।
ডাইরিটা পড়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি চোখের পানিতে ডাইরির পাতাগগুলো ভিজে যায়। পাশে দাঁড়িয়েই রাইসা কাঁদছে।
–কি হলো মা কাঁদছিস কেন?



—বাবা সরি সেদিন তোমাকে মিথ্যা বলার জন্য।
আমি তখন রাইসার ডানহাতটাতে চুমু দিয়ে বললাম।
–মারে, সরি কেন বলছিস।



রাইসা কিছু না বলে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। আমি নীল ডাইরিটাতে একটা চুমু দিয়ে মনে মনে বললাম’ বাকিটা জীবন তোমার স্মৃতি আর আল্লাহর ইবাদত করেই কাঁটিয়ে দিবো। হৃদয়ে থাকবে নীল ডাইরির ভালোবাসার গল্পটা।
সমাপ্ত……….