চলতি অর্থবছরের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে অর্থবছরের দুই অর্ধের জন্য দু’বার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হলেও এবার একবারেই ঘোষণা করা হলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, এখন থেকে এভাবেই প্রতিবছর একবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে। সময়সীমার পরিবর্তনের বাইরে এবারের মুদ্রানীতির ধরন ও ধারণা যদি দেখি- আমি বলব, ব্যাংকিং খাতের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই মুদ্রানীতি সঙ্গতই হয়েছে। সংশ্নিষ্টরা সম্ভবত জানেন, ব্যাংকিং খাতের দুর্বল পরিস্থিতির যেহেতু পরিবর্তন সম্ভব নয়, মুদ্রানীতি দিয়ে যতদূর সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা যেতে পারে, ততটা করা হোক।আমরা দেখছি, এবারের মুদ্রানীতিতে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে। আমার মনে হয়েছে, বাস্তবতার আলোকেই বাংলাদেশ ব্যাংক এই কৌশল নিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে কতগুলো প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসে। যেমন এই মুদ্রানীতির লক্ষ্য কী? এই মুদ্রানীতি কি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ? এসব ক্ষেত্রে প্রশ্ন আছে বলে মনে হয়।
আমরা জানি, বর্তমানে ঋণের যে প্রবৃদ্ধি, তা অর্থনীতির সুস্বাস্থ্যের জন্য পুরোপুরি সহায়ক নয়। সেই পরিস্থিতি মোকাবেলায় বেসরকারি খাতে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, এই লক্ষ্যমাত্রা ‘বাস্তবতার আলোকে’। আমার আশঙ্কা এতখানি অর্জনও হয়তো সম্ভব হবে না। মনে রাখতে হবে, ব্যাংকিং খাতের বর্তমান দুরবস্থার জন্য সরকারি সঞ্চয়পত্র অনেকাংশে দায়ী। সঞ্চয়পত্রের তুলনামূলক উচ্চ সুদের কারণে ব্যাংকিং খাতে অর্থপ্রবাহ বাড়ছে না।আমরা যদি গত এক দশকের চিত্র দেখি- ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট’ স্থিতিশীল ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে; কিন্তু ব্যাংকিং খাতে ‘লিকুইডিটি’ বা তারল্য বাড়ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক বহু চেষ্টা করে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট ধরে রেখেছে। সেটা করতে গিয়ে বিনিময় হার বাড়ানো যাচ্ছে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে; তবে ব্যাংকে স্থানীয় মুদ্রার তারল্য বাড়ছে না। তারল্য সরবরাহের ঘাটতি থাকছে এবং আগামী দিনগুলোতেও থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংক না পারছে বিনিময় হার কমাতে, না পারছে সঞ্চয়পত্রের সুদ কমাতে। আমার মনে হয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আট ভাগে নেওয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, আমাদের মুদ্রানীতি ও ব্যাংকিং খাত সেই প্রবৃদ্ধির সহায়ক হতে পারছে না।
আমরা দেখছি, সম্প্রতি ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণ বেড়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ যেখানে কম, সরকারি খাতে সেখানে ঋণের এই উচ্চহার একটি ভারসাম্যহীনতা তৈরি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ ক্ষেত্রে নিজেদের ঝুঁকি কমাতে সরকারের ঋণকে ‘মানিটাইজ’ করে দিচ্ছে। ফলে ‘হাই পাওয়ার মানি’ বেড়ে যাচ্ছে। আগে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাত থেকে ঋণ কমিয়ে সরকারের খাতে ঋণ বাড়িয়ে দিত। এখন সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি করছে তারল্য সংকট সামাল দিতে। আমার আশঙ্কা, এখন সামলানো গেলেও আগামীতে এই কৌশল বড় সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এতে করে মূল্যস্ম্ফীতি বাড়তে পারে।বড় যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে, ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ব্যাংকিং খাতের দুরবস্থা দূর করার কোনো সুযোগ নেই। বস্তুত এই দুরবস্থা চলতে থাকবে ধরে নিয়ে যতদূর সম্ভব পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে।মুদ্রানীতিতে ইতিবাচক যে দিকটি রয়েছে তা হচ্ছে, ব্যাংকগুলোকে ‘মার্জার’ বা একত্রীকরণের ব্যাপারে সহায়তার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের কোনো সময়সীমা বলা হয়নি। ফলে একত্রীকরণ করতে চাইলেও প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কতদিন লাগবে, সেটা অনিশ্চিত। বছরে একবারই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা একদিক থেকে ভালো। কিন্তু সে ক্ষেত্রে নিশ্চিত করতে হবে, সারা বছর মুদ্রানীতি পরিবর্তন সংক্রান্ত আর কোনো ঘোষণা আসবে না। তাহলে এই খাতে স্থিতিশীলতা আশা করা যায়। তবে অন্তত প্রতি তিন মাসে একবার মুদ্রানীতি পর্যালোচনা করা দরকার। সেই পর্যালোচনার ফল প্রকাশ্য ঘোষণা করতে হবে। তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকের চিন্তা-ভাবনা, মুদ্রানীতির পরিস্থিতি, নীতির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া, পরিবর্তনের সম্ভাবনা সম্পর্কে অন্যরাও জানতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের দেশেও এই পদ্ধতি চালু হতে পারে।