Breaking News

মুক্তমঞ্চ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরান শেয়ারবাজার

সম্প্রতি শেয়ারবাজারে ফের ধস নামার পর স্বাভাবিকভাবেই সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন রকমের বক্তব্য পাওয়া গেছে। কিছু বক্তব্য ও সংবাদ প্রতিবেদন বিভ্রান্তিকর। এসবের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একটি বহুল প্রচারিত দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম ছিল- ‘গত ১৫ দিনে শেয়ারবাজার থেকে সাতাশ হাজার কোটি টাকা উধাও’। ওই সংবাদটি পড়লে যে কেউ চমকে উঠবেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করার আগে মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন বা বাজার মূলধন কী, তা বুঝতে হবে। একটি স্টক এক্সচেঞ্জের নির্দিষ্ট মুহূর্তে তালিকাভুক্ত সব শেয়ার সিকিউরিটিজের বাজার মূল্যের মোট যোগফল হলো, সেই স্টক এক্সচেঞ্জে বাজার মূলধন সেই সময়ের জন্য। একটি কোম্পানির মার্কেট লট শেয়ারেরও লেনদেন হলে তাও হিসাবে আনতে হবে। মাত্র ৫০ বা ১০০ শেয়ার লেনদেনের ফলে ওই কোম্পানির মূলধন পাঁচশ’ কোটি থেকে তিনশ’ কোটি টাকা কমতে পারে।

কোম্পানি যত বড় হবে, ফলও তত বড় দেখাবে। বাজার মূলধন ওঠানামা করে; কিন্তু শেয়ার মালিকের কাছে শেয়ার থেকে যায়। বাজার মূলধনের ইনট্রিনজিক ভ্যালু নেই। একটি দেশের শেয়ার মার্কেটের বাজার মূলধন সেই দেশের মোট জিডিপির চেয়েও বেশি হতে পারে। কিন্তু তা তো আর ছোঁয়া যায় না। যদি তাই হতো, তাহলে তো আর সাহায্যের জন্য ব্যাংক, দাতা সংস্থা লাগত না। প্রতিবেদনে প্রকাশিত হলো, বাজার থেকে পাঁচশ’ কোটি টাকা উধাও। পরে আবার সেই ৫০ বা ১০০টি শেয়ার উচ্চমূল্যে বিক্রি হলে পাঁচশ’ কোটি টাকা ফিরে আসবে। এই যাওয়া-আসার মাঝে কারও কোনো লাভ-লোকসান হয় না। যেহেতু বাজার মূলধন বিভিন্ন সূচকে হিসাব করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তাই সূচকও ওঠানামা করে। অতএব খবরটা এমনভাবে দিতে হবে, যেন শেয়ারহোল্ডারের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি না হয়। আর একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে প্রকাশ, স্টক মার্কেট দেশের অর্থনীতির আয়না। শেয়ার লেনদেন করতে হলে একটি বিও অ্যাকাউন্ট খুলতে হয়। দেশের মোট জনসাধারণের শতকরা দু’জন শেয়ার ব্যবসায়ে লিপ্ত। অতএব, এই আয়নায় দেশের অর্থনৈতিক চেহারার কতটুকু প্রতিফলিত হয়, তা সচেতন পাঠক নিজেই বুঝতে পারেন।

একাধিক অর্থনীতিবিদ বলেছেন, ব্যাংক খাতের অবস্থা খারাপ। ব্যাংক থেকে ঋণ না পাওয়ার ফলে বিনিয়োগকারীর বিচরণ কমেছে শেয়ারবাজারে। শেয়ার মার্কেট দেশের শিল্পায়নের জন্য অর্থ সরবরাহ করতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এমনটি হয়ে থাকে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শেয়ার কেনার প্রশ্ন আসে কেন? ধারে শেয়ার কেনা ঠিক নয়। কেননা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হলে বিনিয়োগযোগ্য উদ্বৃত্ত অর্থ থাকতে হবে। মার্চেন্ট ব্যাংক ঋণ দেয় শেয়ার ব্যবসার নিয়মকানুন মেনে। যেমন মার্জিন মানি দিতে হয়, মাঝেমধ্যে এর সমন্বয় করা হয়। অতএব, শেয়ার বিনিয়োগকারীদের মার্চেন্ট ব্যাংকেই যাওয়ার কথা। বাণিজ্যিক ব্যাংক তার একটি সীমিত পরিমাণ অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। গোটা বিশ্বে এই নিয়ে সতর্কতা এবং নানা বিধিনিষেধ রয়েছে। অনেক দেশে এ রকম বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং শেয়ার মার্কেটের মাঝে অগ্নিদেয়াল থাকবে, যাতে সহজে অতিক্রম না করা যায়। অতি চাঙ্গা বা অতি মন্দাভাবের সময়ে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ সরকারকে চাপ দিতে থাকেন, বাজারে তারল্য বৃদ্ধি করা হোক। তাদের কাছে আকাশ হলো শেয়ারের মূল্যের সীমারেখা। তারা শীর্ষে আহরণের কথা চিন্তা করেন, দিগন্ত বিস্তৃতির কথা ভাবেন না। দিগন্তবিহীন চূড়া একসময় ভেঙে পড়বেই। এনবিআরের সাবেক এক চেয়ারম্যান নাকি বলেছেন, বর্তমানে যেসব তালিকাভুক্ত কোম্পানি রয়েছে, তারা শেয়ারবাজারে ভালো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। নতুন নতুন কোম্পানিকে আসতে হবে।

বেশি করে নতুন কোম্পানি শেয়ার বাজারে আসুক, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু শেয়ারবাজারের সক্রিয়তা আনতে কোম্পানির কী ভূমিকা থাকে, তা বোধগম্য নয়। পরিচালনা পর্ষদের কাজ হবে সুষ্ঠুভাবে কোম্পানি পরিচালনা করা, লাভ হলে লভ্যাংশ দেওয়া এবং আইন অনুযায়ী এজিএম অনুষ্ঠিত করা। শেয়ারহোল্ডাররা তাদের শেয়ার নিয়ে কী করবেন, সেটা তো তাদের ব্যাপার। সংশ্নিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের দাম যতই হোক, সেই টাকা বা অর্থ তো আর কোম্পানির ঘরে আসে না। কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত করতে হলে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের আইপিওতে আসতে হবে। বহুজাতিক কোম্পানি তাদের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আইসিআই, ফিলিপস, ফাইজার কোম্পানি- এদের পণ্যের খুবই জনপ্রিয়তা এবং চাহিদা ছিল, তা সত্ত্বেও এরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে। শেয়ারবাজার সক্রিয় করার জন্য নব্বই দশকের দিকে সরকারের ভালো ভূমিকা ছিল। কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিকে আংশিক বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয় এবং আইপিওতে শেয়ার ছাড়া হয়। গত দুই দশক সরকার একেবারে নিশ্চুপ। চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংককে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করা হয়েছে প্রায় দেড় বছর আগে।

এখন পর্যন্ত একটি শেয়ারও আইপিওতে ছাড়া হয়নি। একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, আগে যে বহুজাতিক কোম্পানি এখানে ছিল, শেয়ারবাজারে তাদের বিনিয়োগ ছিল। শিল্পে অর্থাৎ উৎপাদন পর্যায়ে যদি বহুজাতিক কোম্পানি বিনিয়োগ করে, সেটা দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল। তাহলে পোর্টফলিও পর্যায় এলে সেটা হয় অর্থের শোষণ। এই বিনিয়োগের অর্থকে বলা হয় ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল অর্থাৎ টাকা বিনিয়োগ করে লাভ হিসেবে টাকা নিয়ে যাওয়া। উৎপাদনে কোনো ভূমিকা থাকে না। বিশ্বজুড়ে যে বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে তা হলো, ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল। বলা হয়, ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল হলো অভিশাপ। দারিদ্র্যকে আরও বাড়াচ্ছে। অতএব আমাদের লক্ষ্য থাকতে হবে যে, বিদেশি বিনিয়োগ সরাসরি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় জড়িত হয়। অনেকে বলছেন, একটি লিজিং কোম্পানির অবসায়ন শেয়ার মার্কেটকে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে। যদি করেও থাকে, এ বিষয়টিকে একটু ভিন্ন চোখে দেখতে হবে। আমাদের দেশে অবসায়ন সহজে হয় না। অহেতুক রুগ্‌ণ-পক্ষাঘাতগ্রস্ত কোম্পানিকে টেনে নেওয়া হয়, এটা ঠিক নয়। অবসায়ন প্রক্রিয়া আরও সহজ করা উচিত এবং অবসায়নযোগ্যদের অবশ্য দ্রুত অবসায়ন করতে হবে। শেয়ার মার্কেটকে বুঝতে হবে যে, চলার পথে নানা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়।

একদিকে লভ্যাংশ প্রদানে বাধ্য করা এবং অন্যদিকে না দেওয়া এ রকম দুমুখো নীতি কেন নেওয়া হয়েছে, তা পরিস্কার নয়। রিটেন্ড আর্নিং বা রিজার্ভের পরিমাণ পরিশোধিত মূলধনের ৭০ ভাগের বেশি হলে অতিরিক্ত অর্থের ওপর ১৫ শতাংশ কর বসানো হয়েছে। অর্থাৎ কোম্পানিকে বাধ্য করা হয় লভ্যাংশ দিতে। স্টক ডিভিডেন্ডের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এদিকে পরিচালক এবং উদ্যোক্তাদের শেয়ারহোল্ডিংয়ের পরিমাণ ৩০ শতাংশের কম হলে সে কোম্পানি লভ্যাংশ দিতে পারবে না।

এ বিষয়গুলো কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের নিজস্ব ব্যাপার। উদ্যোক্তারা যদি কম শেয়ারের মালিক থেকেও খুব সুষ্ঠুভাবে কোম্পানি পরিচালনা করতে পারেন, তাতে আপত্তি থাকবে কেন। কিছু কিছু উদ্যোক্তা থাকতে পারেন, যারা তাদের দক্ষতা ও প্রতিভা দিয়ে কোম্পানির উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটিয়েছেন বা ঘটাতে পারেন। স্কুল পালানো ছেলে দিরুভাই আম্বানি মধ্যপ্রাচ্যের এডেনে পেট্রোল পাম্পে চাকরি করতেন। সেখান থেকে ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ভারতীয় মুদ্রায় ৬০ হাজার কোটি রুপির সম্পদ রেখে যান। এটা নিশ্চয়ই তার অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় ও যোগ্যতারই সাক্ষ্য বহন করে। তাদের ছেলেরা কতটা কী করতে পেরেছেন পরে, সেটা ভিন্ন কথা। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আইপিও ও তালিকাভুক্ত কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বেশি মাত্রায় বিধিবিধান তৈরি এবং প্রয়োগ করছে। বিএসইসির মনে রাখা উচিত, স্টক এক্সচেঞ্জকে ডিমিউচুয়ালাইজেশন করা হয়েছে প্রতিষ্ঠানকে করপোরেট রূপ দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা, বিএসইসির খবরদারি বাড়ানোর জন্য নয়। একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শেয়ারবাজারের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি, যথা অত্যন্ত চাঙ্গা বা মন্দাভাবের অবসানের জন্য মূল বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। তাতে একটু সময় লাগলেও লাগতে পারে। কিন্তু স্টেরয়েড প্রয়োগ করা ঠিক নয়। শেষ কথা হলো, সর্বাগ্রে বিনিয়োগকারীদের হূত আস্থা পুনরুদ্ধারে সবরকম ব্যবস্থা নিশ্চিত করা চাই।

Check Also

পুকুর সেঁচে পাওয়া গেলো বড় বড় ইলিশ!

ভোলায় চরফ্যাশন উপজেলার একটি পুকুর সেঁচে মিলেছে বড় সাইজের ৮টি ইলিশ মাছ। প্রতিটি ইলিশের ওজন …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *