গত কয়েক দশকের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম হলো নারীর অধিকার। কিন্তু এই অধিকারের সংজ্ঞা বা আওতা এখনো অস্পষ্ট। নারীর ক্ষমতায়নকে এখনো পুরুষের সঙ্গে তুলনা করে নির্ণয় করার চেষ্টা চলছে। এই তুলনা কতোটা নির্ভুলভাবে করা হচ্ছে, তার কোনো মূল্যায়ন নেই।বিগত দশকগুলোর অভিজ্ঞতা বলে– নারীবাদী আন্দোলন বহুধা-বিভক্ত, নারীবাদের একক স্বরূপ এখনো নির্ণয় করা যায়নি এবং নারীবাদ প্রায়ই ‘পুরুষ-বিদ্বেষ’-এ রূপ নেয়। অনেকে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি– নারীবাদ নারীর একার বিষয় নয়; নারীবাদের মধ্যে নারী ও পুরুষের যৌথ ও শান্তিপূর্ণ এবং যৌক্তিক সহাবস্থান নিশ্চিত করার চেষ্টা থাকা চাই যা শেষ পর্যন্ত উভয়ের মধ্যে ক্ষমতার সুষ্ঠু ও যৌক্তিক বণ্টনের মাধ্যমে ভারসাম্য নিশ্চিত করবে। এ ক্ষমতা আর্থিক-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক। আর ক্ষমতার এই ভারসাম্যের প্রমাণ স্পষ্ট হতে হবে নিজের জীবনে, পরিবারে, সমাজে এবং রাষ্ট্রে।
আমাদের বহুদিনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষণীয় হলো, নারীর অধিকার পুরুষের থেকে আসবে– এমন একটা নিশ্চিত নির্ভরতা কোথাও যেন আমাদের মনে বাসা বেঁধে আছে। অভিজ্ঞতা বলছে, পুরুষ নিজের ক্ষমতা-কাঠামোকে কারো সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চায় না। আর এজন্যে আমরা যেন ‘কিচ্ছুটি করার নেই’– এমন একটা ভাব করে বসে আছি। ‘পুরুষের এই সমাজ’কে পুরুষ যে ভাঙতে দেবে না– এটিই তো স্বাভাবিক! এই পরিস্থিতিতে নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে নিজের অবস্থার পরিবর্তনে। নারীর এই প্রচেষ্টায় কোনো উদার মনের পুরুষ সহযাত্রী হলে ভালো, না হলে ‘একলা চলো রে’ নীতিতেই নারীকে এগিয়ে যেতে হবে।তবে ক্ষমতায়ন ও নিরাপত্তার ইস্যুতে নারীর বর্তমান অবস্থার জন্যে পুরুষ বা পুরুষতান্ত্রিকতা যেহেতু সবচেয়ে বেশি দায়ী, তাই সেই দায়বোধ থেকে পুরুষের এগিয়ে আসাই কাম্য। সমাজের অর্ধেক অংশ পুরুষ বাকি অর্ধেক অংশ নারীর পথের কাঁটা হয়ে থাকবে– তা কোনোভাবেই সভ্যতা হতে পারে না। আর অনেক নারীর মধ্যেও পুরুষতান্ত্রিকতার যে প্রচ্ছন্ন ছাপ রয়ে গেছে, তাদেরও উচিত হবে সেটিকে শনাক্ত করা এবং এর প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করা।
নারীকে সবসময় মনে রাখতে হবে– এ সমাজ নারীর নয়, পুরুষের। পুরুষেরা অন্তত এভাবেই সমাজকে সৃষ্টি করেছে। তাই নারীর উচিত হবে নিজেকে প্রকৃত শিক্ষায় উপযুক্ত করে গড়ে তুলে ‘পুরুষের’ এই সমাজকে ‘মানুষের’ সমাজে রূপান্তর ঘটানো। কেবল পুরুষের বা কেবল নারীর সমাজ নারী-পুরুষ উভয়ের পক্ষেই অকল্যাণকর; কেবল মানুষের জন্যে নির্মিত সমাজই সবার জন্যে মঙ্গলজনক। কেবল ‘মানুষের’ জন্যে সৃষ্ট সমাজেই নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ-তৃতীয় লিঙ্গ এমনকি ধর্ম-বর্ণ-যৌনতা নির্বিশেষে সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব। আর এজন্যে রাষ্ট্রকে আরো উদার, সহনশীল ও উদ্যোগী হতে হবে।নারী আজ ঘরে নিরাপদ নয়, বাইরে নিরাপদ নয়; সড়কে নিরাপদ নয়, যানবাহনে নিরাপদ নয়। নারীর প্রতি অসম্মান, অবহেলা, তাচ্ছিল্য আর বিদ্বেষের কালো মেঘে আমাদের সমাজ এখনও অন্ধকারাচ্ছন্ন। এই অন্ধকারে নারীকে পথ চলতে হচ্ছে একাকী; হয়তো ভবিষ্যতেও একাই চলতে হবে। তাই নারীকে অন্ধকার পথে একলা চলার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে। এজন্যে অন্ধকারে পথ দেখাতে নারীকে নিজেই নিজের প্রদীপ হতে হবে, নিজের জন্যে নিজেকেই আলো জ্বালতে হবে।নারীর জয় হোক, জয় হোক বিশ্বমানবতার!