Breaking News

সম্পাদকীয় ও মন্তব্য বন্যা নিয়ে যার যা করণীয় আলোর ইশারা

জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বন্যার খবর জোরেশোরে প্রকাশ হচ্ছে। খবরের কাগজে বন্যায় আক্রান্ত মানুষের দুঃখকষ্টের কথা তুলে ধরা হচ্ছে এবং ত্রাণ কার্যক্রম ততটা পর্যাপ্ত নয়, ইত্যাদি লেখা হচ্ছে। এর আগে গত ১৬ জুলাই সমকালেই এ বছরের বন্যা নিয়ে লিখেছিলাম। এবার আরও কিছু কথা।মনে রাখতে হবে, বন্যা বাংলাদেশের জন্য একটি বার্ষিক ঘটনা। কোনো বছর বেশি মাত্রায়, কোনো বছর কিছুটা কম। কোনো বছর কিছুটা আগে, কোনো বছর কিছুটা দেরিতে আসে। এটা নিয়ে আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। যে কোনো বন্যার ‘নেচার’ সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা উচিত। এবারে প্রিন্ট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে প্রচারিত বন্যার খবর আমাদের কিছুটা ‘কনফিউশনে’ ফেলেছে। আমি কনফিউশনের পরিবর্তে ‘বিভ্রান্ত’ শব্দটি ব্যবহার করিনি। করলে মনে করা হতো ভুল খবর প্রচার করা হচ্ছে। দেশের বহু জায়গায় পানি বেড়ে তা মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়েছে, এটা অত্যন্ত সত্যি কথা। কিন্তু ওই স্থানগুলোতে পানি বাড়াটা কি অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল? এর জন্য কি কোনো পূর্বাভাস ছিল? এর জন্য কি বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী ব্যবস্থা ছিল? এই প্রশ্নের উত্তরগুলো পেলে পানি উঠে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরসনে কী করা উচিত, তা নিয়ে নতুনভাবে ভাবার সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

কেউ যদি পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে দেখেন, তাহলে এবারের বন্যা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে পারবেন। যেমন প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনা নদীর যে এলাকার পানির উচ্চতাকে প্রভাবিত করে, সেই অংশে অনেক পয়েন্টে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। নদীটি ভারত থেকে বাংলাদেশে যেখানে ঢুকল, সেই পয়েন্টটির নাম হচ্ছে নুনখাওয়া। সেখানে ঢুকলে দেখা যাবে, দিন পনেরো আগে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। এর আগে ২০১৭ কিংবা ১৯৯৮ সালে এর থেকে সাত দিন আগে পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছিল। এখন পানি নেমে গিয়ে বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এর পরে এই নদী দিয়ে চিলমারী, বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ, পোড়াবাড়ী এবং আরিচা পয়েন্টের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। সব পয়েন্টেই পানির প্রবাহের ধারা একটু লক্ষ্য করলে নুনখাওয়ার মতো অবস্থাই দেখা যাবে। অর্থাৎ পানি বেড়েছিল, তা অনেক কমে এসেছে গত এক সপ্তাহে। তারপর একটু বেড়েছে, কিন্তু মনে হচ্ছে আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিপদসীমার ওপরেই থাকবে। এই পয়েন্টগুলোর ভাটিতে অর্থাৎ গোয়ালন্দ, ভাগ্যকূল বা মাওয়া এবং সুরেশ্বরে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি রয়েছে। মূল ব্রহ্মপুত্রের পানি পুরাতন ব্রহ্মপুত্র দিয়ে ঢুকে ডেমরা নারায়ণগঞ্জে পৌঁছায়। সেখানে পানি বিপদসীমার কাছাকাছি। বেশ কিছুদিন সেই অবস্থাতেই থাকবে এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি ওঠানামায় বাংলাদেশের ভেতরের বৃষ্টি খুব অল্প ভূমিকা রাখে। মূলত ভারত থেকে এই পানি প্রবেশ করে।

অন্যদিকে সুরমা-কুশিয়ারা অববাহিকায় চিত্র কিছুটা ভিন্ন। সেখানেও প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশে পানি প্রবেশ করে ভারত থেকে। কুশিয়ারার অমলসিদ নামক স্থানে পূর্বাভাস দেওয়া হয়। আগের কয়েক বছরে যেখানে মে মাসের মাঝামাঝিতে বন্যা হয়েছে, সেখানে এ বছর পানি উঠেছে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে। পানি দিন পনেরো বিপদসীমার ওপরে থেকে কমে বিপদসীমার নিচে চলে এসেছে। এখন আবার তা বাড়ছে। এই অববাহিকার নদীগুলোর সবক’টিতেই আগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পানি বিপদসীমার ওপরে থাকবে। তবে এর মধ্যে মেঘালয়ে ভারি বৃষ্টি হলে পানি আরও বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে দেশের উত্তর-পূর্বে বগুড়া কিংবা নওগাঁ এলাকায় বন্যার যে অবস্থা দেখা গেছে, সেগুলো মূলত দেশের ভেতরের বৃষ্টির কারণে। অন্যদিকে লালমনিরহাটে তিস্তা কিংবা কুড়িগ্রামে ধরলার পানি অতি দ্রুত ওঠানামা করে উজান থেকে আসা পানির কারণে।প্রশ্ন হলো, বিপদসীমা কাকে বলে? কার বিপদ? এই বিপদসীমা জনসাধারণের জন্য কতটা বিপদের কথা বলে? বিষয়গুলো বুঝলেই খবরের কাগজে যে ভয়াবহ বন্যার ছবি ছাপা হয়েছে, তার ভয়াবহতা বহুলাংশে কমে যাবে। প্রথমেই বলি, যমুনা কিংবা তিস্তার পানির উচ্চ সীমারেখা সর্বকালের উচ্চতাকে ছাপিয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে বলা দরকার, এই দুটি নদীসহ আমাদের দেশের অধিকাংশ নদীর দুই পাড়ে এখন বন্যা নিয়ন্ত্রণকারী বাঁধ রয়েছে, অথবা গ্রামীণ সড়কগুলো পানিপ্রবাহে বাধা দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করছে। একইভাবে বলতে হয়, বহু জায়গায় সড়কগুলো জলাবদ্ধতার কারণ হয়েছে।

তাহলে বিপদসীমা শব্দটিকে বোঝা দরকার। যে কোনো নদীর একটি স্থানে নদীর পানির স্তর বেড়ে যদি প্লাবনভূমিতে প্রবেশ করে ফসল কিংবা বাড়িঘরের ক্ষতি করার আশঙ্কা দেখা দেয়, সেই স্তরকে বিপদসীমা বলা হয়। যে নদীর পাড়ে বাঁধ নেই, সেখানে নদীটি কানায় কানায় ভর্তি হলেই বোধকরি তাকে বিপদসীমা বলা যেতে পারে। অর্থাৎ একটি নদী বিপদসীমা অতিক্রম করলেই বন্যার সৃষ্টি হয় না। আর যেখানে নদীর পাড়ে বাঁধ আছে, সেখানে পুরনো বছরের গড় বন্যার উচ্চতা ধরেই বিপদসীমা বলা হয়। অর্থাৎ বড় একটি নদীর পাড়ের নির্মিত বাঁধের উচ্চতা থেকে পাঁচ-ছয় ফুট নিচে থাকতেই তাকে বিপদসীমা বলা হয়।ব্রহ্মপুত্রের দুই পাড়েই বাঁধ আছে। কোনো জায়গাতে বাঁধ উপচে পানি ঢুকেছে- এমন প্রমাণ পাইনি। তাহলে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাতে বন্যা কোথায় হলো? সেখানে বাঁধ ভেঙেছে দু-একটি জায়গায়। যেমন বাম তীরের জামালপুরের তারাকান্দি এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ যেখানে বাঁধ আছে, সেখানে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে- এর অর্থ এই নয় যে বন্যা হচ্ছে। অবশ্য বাঁধের বাইরে যারা আছেন, অর্থাৎ যারা অরক্ষিত, যারা চরাঞ্চলে বাস করেন, তাদের জমিজমা কিংবা বাড়িঘর ডুবে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। একটি স্বাভাবিক ঘটনার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে তা কেন ‘বিপদ’ হিসেবে চিহ্নিত হবে?

আবার হাওরাঞ্চলে যেখানে ‘ডুবন্ত’ বাঁধ নির্মাণ করা হয়ে থাকে, সেখানে বিপদসীমা শব্দটি আরও গোলমেলে। কারণ সেখানে বর্ষাকালে হাওরের ফসল রক্ষাকারী বাঁধগুলো ডুবে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক। সুনামগঞ্জ শহর রক্ষাকারী বাঁধের ক্ষেত্রে বিপদসীমাটি সুনামগঞ্জ শহরবাসীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু সুরমা নদীর অপর তীরে খরচার হাওর এলাকার লোকজনের জন্য প্রযোজ্য নয়। স্বাভাবিক বর্ষার পানির উচ্চতাকে ধরে নিয়ে হাওরাঞ্চলের গ্রামবাসী ভিটাবাড়ি অনেক উঁচু করে বানান। তাদের কারও বাড়ি পানিতে ডুবেছে বলে শুনিনি। অথচ খবরের কাগজে মানুষ ‘পানিবন্দি’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।এই প্রসঙ্গে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কাছে আমার একটি বিনীত আবেদন রয়েছে। বন্যায় প্লাবিত একটি এলাকা বা বসতবাড়িকে দেখানোর সময় কত তারিখে এবং কোন এলাকা থেকে ওই ছবিটি নেওয়া হয়েছে, তা চিহ্নিত করা আবশ্যক। আমি অনেকটা সাহস করে বলতে পারি, সব খবরের কাগজে ছাপানো বন্যার ছবি কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে দেখানো বন্যার ভয়াবহ অবস্থা মূলত বাঁধের বাইরে থেকে এবং চরাঞ্চল থেকে নেওয়া হয়েছে। এটা কোনোমতেই বন্যা নয়।আমি ডুবে যাওয়া মানুষের দুঃখকষ্টকে কোনোমতে খাটো করে দেখছি না। তাদের সহায়তার প্রয়োজন আছে, এসব মানুষকে কোনোদিনই বন্যামুক্ত করা যাবে না। বন্যামুক্ত করার চিন্তাও করা উচিত নয়। তাদের জন্য অন্য ধরনের ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। পানি বেড়ে তাদের উঠান ডুবে গেলে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এলাকার স্কুল-কলেজগুলোকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নির্মাণ করা যেতে পারে। মাঠের ফসল কিংবা পুকুরের মাছও এমন ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে, যাতে তারা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন না হয়। যে কোনো বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পানির উচ্চতা বেশি থাকতে পারে। কাজেই নদীর পানির গতিবিধি লক্ষ্য রেখে তবেই সংশ্নিষ্ট অঞ্চলে মাঠে ফসল লাগানো উচিত। এমন ফসল লাগানো উচিত, যা পানির সঙ্গে বাঁচতে পারে।

সংবাদমাধ্যমে দেখছি, রাস্তার ওপর দিয়ে পানি যাচ্ছে, এমনকি রেললাইনও পানির তলায়। এটি সম্পূর্ণভাবে প্রকৌশলীদের ব্যর্থতা। রাস্তা নির্মাণের সময় বৃষ্টির পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিকল্পনায় আনা হয়নি। আমাদের দেশে স্থানীয় পর্যায়ে গ্রামীণ রাস্তাঘাটের সম্প্রসারণ ঘটেছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রায় সর্বত্রই প্লাবনভূমি ছোট ছোট ব্লক বা কম্পার্টমেন্টে পরিণত হয়েছে। একটি কম্পার্টমেন্ট থেকে পানি অন্য কম্পার্টমেন্টে যাওয়ার জন্য এবং সেখান থেকে নিকটস্থ নদীতে নিস্কাশিত হওয়ার জন্য যে রাস্তা ছিল, তা হয় বন্ধ, না হলে অপর্যাপ্ত। এতে করে প্রতিটি কম্পার্টমেন্টের পানি ফুলে উঠে রাস্তার ওপর দিয়ে পাশের কম্পার্টমেন্টে প্রবেশ করছে। অর্থাৎ কালভার্ট বা সেতুগুলোর মাধ্যমে পানি নিস্কাশনের ক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অপ্রতুল। এ কারণেই ব্রিটিশ আমলে নির্মিত রেললাইনটিও পানিতে তলিয়ে যেতে দেখছি। ওই সময়ে গ্রামীণ রাস্তাঘাট ছিল না বললেই চলে। বৃষ্টির যে ধরন ছিল, তাও পরিবর্তিত হয়েছে।এখন সরকারের উচিত হবে, বন্যায় আক্রান্ত প্রতিটি এলাকাকে আলাদাভাবে বিশ্নেষণের মাধ্যমে ওই এলাকাটি পানিতে ডুবে যাওয়ার কারণ বের করে তার সমাধান করা। স্লুইসগেট বা রেগুলেটরকে কার্যকর রাখা।প্রতি বছরই বন্যা হতে পারে। কাজেই ভবিষ্যতের বন্যার ব্যবস্থাপনা এখন থেকেই গড়ে তুলতে হবে, ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডার অন ডিজাস্টার’ ধরে। পানি উন্নয়ন বোর্ডকে সঠিকভাবে বিশ্নেষণ করতে হবে, প্রতিটি স্থানের জন্য পানি ওঠার কারণ। সংবাদমাধ্যমকে পানি দেখলেই ‘বন্যা’ বলা বন্ধ করতে হবে। দুস্থ-দরিদ্র মানুষের জন্য সরকার সহযোগিতার হাত বাড়াবে, ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করবে- এটাই কাম্য। মনে রাখতে হবে, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বৃষ্টির প্রকোপ বাড়তে পারে। আবার দেশের এক অংশ যখন পানিতে ডুবে গেছে, তখন অন্য অংশ বৃষ্টি ও পানির জন্য হাহাকার করছে। এ কথা মনে রেখেই বন্যা ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। পানি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ; ইমেরিটাস অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়।সুত্রঃ সমকাল

Check Also

নারীর অধিকার: নিজেকেই নিজের প্রদীপ হতে হবে

গত কয়েক দশকের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম হলো নারীর অধিকার। কিন্তু এই অধিকারের সংজ্ঞা বা …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *